বিটিবি নিউজ ডেস্ক: দুঃসহ গরমের মাঝে হজযাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়; যেন দাঁড়ানোর মতো তিল পরিমাণ জায়গা নেই। এর মাঝেই হজের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে গিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা হজযাত্রীদের। সৌদি আরবে তীব্র তাপদাহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা হজযাত্রীদের প্রাণও কাড়ছে। মঙ্গলবার সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, মক্কার পবিত্র গ্র্যান্ড মসিজদের ছায়ায় তাপমাত্রা ৫১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১২৫.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছায় বার্ষিক হজ যাত্রার সময় প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে।
জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, হজের সময় হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জর্ডানের ৬ জন নাগরিক মারা গেছেন। পরবর্তীতে এক বিবৃতিতে সৌদিতে হজের সময় জর্ডানের নাগরিকদের প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ১৪ জন হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। যদিও হজ পালনের সময় জর্ডানের এই নাগরিকদের প্রাণহানির সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ জানানো হয়নি।
মঙ্গলবার ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা আইআরআইএনএন বলেছে, পবিত্র হজ পালনের সময় সৌদিতে অন্তত ১১ ইরানি নিহত হয়েছেন। এছাড়া অসুস্থ আরও ২৪ ইরানিকে সৌদি আরবের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে সৌদিতে হজের সময় ইরানি নাগরিকদের প্রাণহানির কারণ জানায়নি দেশটি।
এদিকে, সুদানের সংবাদমাধ্যম বলেছে, হজের সময় সৌদিতে সুদানের তিন নাগরিক নিহত হয়েছেন। আর ইন্দোনেশিয়ার একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সোমবার ফরাসি সংবাদমাধ্যম লি মন্ডেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ বছর হজ পালনের সময় সৌদিতে ১৩৬ ইন্দোনেশীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
সৌদি আরবের পবিত্র হজের সময় পদদলন, তাঁবুতে অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় গত ৩০ বছরে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। যে কারণে হজের আনুষ্ঠানিকতা নিরাপদে সম্পন্ন ও হজযাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে সৌদি সরকার। দেশটির কর্তৃপক্ষ বর্তমানে চরম তাপদাহ থেকে হজযাত্রীদের রক্ষা করতে গিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
ট্রাভেল অ্যান্ড মেডিসিন জার্নালের চলতি বছরের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা তাপ প্রশমনের কৌশলগুলোকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। আর জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্সের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৌদি আরবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় হজযাত্রীরা ভবিষ্যতে ‘‘চরম বিপদের’’ সম্মুখীন হবেন।
সৌদি আরবের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, অত্যন্ত উচ্চ-তাপমাত্রার মাঝে হজ পালনকারী মুসলিম হজযাত্রীদের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে পায়নি কর্তৃপক্ষ। সৌদির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরুরি অধিদপ্তরের প্রধান জামিল আবুলেনাইন বলেছেন, ‘‘আমরা হজের সময় হজযাত্রীদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর স্বাভাবিক সংখ্যায় কোন অস্বাভাবিক ঘটনা কিংবা বিচ্যুতি দেখতে পাইনি।’’
মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত তাপজনিত অসুস্থতায় ভোগা ২ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি হজযাত্রীকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গত রোববার রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিসরীয় এক হজযাত্রী বলেছিলেন, ‘‘হজ একটি কঠিন কাজ, তাই আপনাকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাপদাহ ও ভিড়ের পরিস্থিতিতেও হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে।’’
সূর্যের প্রবল তাপ থেকে নিজেদের রক্ষায় হজযাত্রীরা ছাতা ব্যবহার করেন। সৌদি কর্তৃপক্ষ হজযাত্রীদের হাইড্রেটেড থাকার বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। এমনকি দিনের উষ্ণতম সময় সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে বাইরে অবস্থান না করার জন্য পরামর্শও দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাগমগুলোর একটি পবিত্র হজ। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি এই হজ। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা ফরজ। চলতি বছরের হজ শেষ হবে বুধবার।
মরু আবহাওয়ার দেশ সৌদি আরবে তাপমাত্রার পারদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ বছর হজ পালনের সংকল্প করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সৌদিতে আসা প্রায় ১৮ লাখ মুসলিম তীব্র গরম উপেক্ষা করেই হজ সম্পাদন করছেন।
সৌদি আরবে প্রত্যেক দশকে আঞ্চলিক তাপমাত্রা গড়ে শূন্য দশমিক ৪ সেন্টিগ্রেড হারে বাড়ছে এবং প্রশমন ব্যবস্থা নেওয়ার পর তাপদাহ পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করছে।
সৌদি আরবের সরকার হজ পালনের সময় হজযাত্রীদের হতাহতের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে জলবায়ু-নিয়ন্ত্রিত এলাকাসহ তাপ প্রশমনের বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে দেশটি। এছাড়া হজযাত্রীদের মাঝে বিনামূল্যে পানি বিতরণ ও সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের সুরক্ষার পরামর্শ দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার সৌদিতে হজ পালনের সময় নিজ নাগরিকদের হতাহতের বিষয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সেই হিসেবে গত বছর হজের সময় সৌদিতে কমপক্ষে ২৪০ জন হজযাত্রী প্রাণ হারান। যাদের অনেকেই ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক। তবে এই হজযাত্রীদের মৃত্যুর কারণ নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।
সৌদি আরবের সরকারি এক কর্মকর্তা ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, গত বছর হজের সময় ১০ হাজারের বেশি তাপজনিত অসুস্থতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ শতাংশই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
সৌদির এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশটিতে প্রত্যেক দশকে আঞ্চলিক তাপমাত্রা গড়ে শূন্য দশমিক ৪ সেন্টিগ্রেড হারে বাড়ছে এবং প্রশমন ব্যবস্থা নেওয়ার পর তাপদাহ পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করছে।-সূত্র: রয়টার্স, এএফপি, লে মন্ডে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন